বাংলাদেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের সমৃদ্ধ প্রত্নঅঞ্চলগুলোর মধ্যে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার প্রত্ননগরী বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এখানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা প্রায় শতাধিক প্রত্নস্থাপনা মধ্যযুগীয় বাংলার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের অনন্য সাক্ষ্য বহন করছে। এর মধ্যে গোড়ার মসজিদ একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা—যা কেবল স্থাপত্যনৈপুণ্যের নিদর্শন নয়, বাংলার সুলতানি আমলের ধর্মীয়–সামাজিক ইতিহাসেরও গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
ঝিনাইদহ–যশোর আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে প্রায় ২৫ কিলোমিটার অতিক্রম করলে বারোবাজার ইউনিয়নের বেলাট দৌলতপুর মৌজায় দেখা মেলে এই প্রাচীন মসজিদের। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা গোড়ার মসজিদ আজ পর্যটক, প্রত্নগবেষক, ইতিহাসবিদ এবং স্থাপত্য অনুরাগীদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু।
ঐতিহাসিক পটভূমি : বারোবাজার প্রত্ননগরীর সাথে যোগসূত্র
বারোবাজার অঞ্চলটির ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। মধ্যযুগে এটি “গোপালপুর” নামে পরিচিত ছিল, এবং গবেষকদের মতে ১৪শ–১৬শ শতকে বাংলার সুলতানি শাসনের সময় এটি একটি পরিপূর্ণ নগরকেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে পাওয়া গেছে—
- মসজিদ
- মাজার
- দালান ও প্রাসাদসম ধ্বংসাবশেষ
- রাস্তার চিহ্ন
- বসতভিটা
- ইদগাহ
- প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্রের অবশেষ
এই বৃহৎ প্রত্নঅঞ্চলের অন্যতম কেন্দ্রীয় স্থাপনা হলো গোড়ার মসজিদ, যা একসময় এলাকার ধর্মীয় জীবন ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের মূল কেন্দ্র ছিল বলে ধারণা করা হয়।
মসজিদের নামকরণের উৎস : “গোড়ার মসজিদ” কেন?
“গোড়া” শব্দটির সঠিক উৎস স্পষ্ট নয়, তবে কয়েকটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়—
- স্থানীয় উপভাষা অনুযায়ী, “গোড়া/গোড়াই” শব্দটি অনেক সময় গ্রাম বা বসতির নাম নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হতো।
- কেউ কেউ মনে করেন, মসজিদের কাছে ‘গোড়াই/গোড়াল’ নামে একটি ছোট জনপদ বা বাজার ছিল।
- স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, “গোড়া” নামের কোনো ব্যক্তির উদ্যোগে মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল।
যদিও প্রমাণ যথেষ্ট নয়, তবে নামটি স্থাপনার ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচায়ক।
স্থাপত্য বিশ্লেষণ : বাংলার সুলতানি শিল্পধারার প্রতিফলন
গোড়ার মসজিদ বাংলার সুলতানি আমলের ইট–নির্মিত স্থাপত্যরীতির উৎকৃষ্ট অনুসরণে গড়া। বাংলার মসজিদ স্থাপত্যে গম্বুজ, খিলান, পুরু প্রাচীর, টেরাকোটা অলংকরণ ইত্যাদি চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। গোড়ার মসজিদেও একই ধারা লক্ষ্য করা যায়।
মসজিদের মূল বৈশিষ্ট্য :
১. ইট–নির্মিত শক্তিশালী স্থাপত্য
মসজিদের দেয়ালে ব্যবহৃত ইটগুলো সুলতানি আমলের স্বাভাবিক মাপের —
২৪ × ১৮ × ৫ সেমি, যা সে সময়কার নির্মাণশৈলীর প্রমাণ।
২. মিহরাবের সূক্ষ্ম নকশা
মসজিদে অবস্থিত মিহরাবটি ছিল অর্ধবৃত্তাকার, এবং এর দেয়ালে অলংকরণে বাংলার সুলতানি স্থাপত্যরীতির চিহ্ন পাওয়া যায়।
৩. গম্বুজব্যবস্থা
বর্তমান অবশিষ্ট অবকাঠামো দেখে স্থপতিরা মনে করেন, এটি হয়তো—
- একগম্বুজ
অথবা - বহু–গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ ছিল।
৪. খিলানযুক্ত দরজা–জানালা
এগুলো শুধুমাত্র শৈল্পিক সৌন্দর্য বাড়ায়নি, বরং বাতাস চলাচল ও আলো প্রবেশেরও সুবিধা দিয়েছে।
৫. পারিপার্শ্বিক অবকাঠামো
মসজিদের চারপাশে পাওয়া গেছে বসতবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, যা নির্দেশ করে এটি ছিল এক প্রাণবন্ত বসতি–কেন্দ্রের অংশ।
বারোবাজার প্রত্ননগরীর কেন্দ্র হিসেবে গোড়ার মসজিদ
গোড়ার মসজিদকে কেন্দ্র করে বারোবাজারে গড়ে উঠেছিল সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ড। পুরো প্রত্ননগরীটি সম্ভবত ছিল—
- একটি সামরিক–প্রশাসনিক কেন্দ্র
- বাণিজ্যকেন্দ্র
- ধর্মীয় শিক্ষার স্থান
- যাত্রী বিশ্রামকেন্দ্রসহ নগর পরিকল্পনার অংশ
গোড়ার মসজিদের অবস্থান দেখে ধারণা করা হয়, এটি ছিল শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সংরক্ষণ ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগ
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর গোড়ার মসজিদকে “সংরক্ষিত প্রত্নস্থল” হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। সংরক্ষণ কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে—
- স্থাপনার বাকি অংশ পুনরায় গঠনের প্রচেষ্টা
- চারপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখা
- পর্যটকবান্ধব পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ
- গবেষণা/ডকুমেন্টেশন করা
যদিও মসজিদের অধিকাংশ অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবুও এর মৌলিক কাঠামোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
পর্যটন সম্ভাবনা : কেন দেখবেন গোড়ার মসজিদ?
বারোবাজার প্রত্ননগরী ভ্রমণের পথে গোড়ার মসজিদ অন্যতম আকর্ষণ। এখানে আসলে—
- বাংলার সুলতানি স্থাপত্য গভীরভাবে বোঝা যায়
- মধ্যযুগীয় ইসলামী সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ চোখে দেখা যায়
- বারোবাজার প্রত্ননগরীর অন্যান্য ৩০+ নিদর্শনের সাথেও পরিচয় হয়
- গবেষণা বা ছবি তোলার জন্য অত্যন্ত উপযোগী পরিবেশ
বাংলাদেশে প্রত্নপর্যটনের একটি সম্ভাবনাময় জায়গা হলো গোড়ার মসজিদ।
কীভাবে যাওয়া যায়
- অবস্থান: বেলাট দৌলতপুর মৌজা, বারোবাজার ইউনিয়ন, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ
- ঝিনাইদহ–যশোর মহাসড়ক থেকে সহজেই পৌঁছানো যায়
- ঝিনাইদহ শহর থেকে দূরত্ব : ~৩৫ কিমি
- কালীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে : ~১০ কিমি
রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যান ও স্থানীয় বাস সার্ভিসে যাওয়া যায়।